লিখেছেন, ইনামুল হাফিজ লতিফী;
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের নায়কোচিত আবির্ভাব ঘটে নব্বইয়ের দশকের
মাঝামাঝি সময়ে। কালের পরিক্রমায় এই শিল্পের কল্যাণে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে
প্রায় ৪২ লাখ শ্রমিকের। শতভাগ রপ্তানিমুখী এই শিল্প বিগত অর্থবছর ২০১৫-১৬ এ ২৮.০৯
বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করেছে যা
বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২%। জিডিপিতে এই খাতটির অবদান অর্থবছর
২০১৫-১৬ এ এককভাবে ছিল ১৪%। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত,
প্রথমত, নীটওয়্যার (এইচএস কোড ৬১) শিল্প এবং দ্বিতীয়ত, ওভেন গার্মেন্টস (এইচএস কোড
৬২) শিল্প।
প্রসঙ্গত, নীট তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অভ্যন্তরে বিগত বছরগুলোতে
৭৫%-৮০% পর্যন্ত মূল্য সংযোজন করে যাচ্ছে, অর্থ্যাৎ এই শিল্প বিদেশে রপ্তানি বাবদ অর্জিত রপ্তানি
আয়ের সিংহভাগই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।
সামগ্রিকভাবে, ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ কারখানা মিলিয়ে প্রায় ৭০০০ এর মতো কারখানা
বর্তমানে এদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রার সাথে জড়িত। কিন্তু, বৈরী বৈশ্বিক বাণিজ্যিক
অবস্থা এবং দেশীয় বিমাতাসুলভ কিছু নীতি, সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি কিছু কিছু ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট
নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দূরদর্শিতার অভাবে এই শিল্প ততটুকু রপ্তানি আয় অর্জন করতে
পারছে না, যতটুকু এই খাতটি থেকে সম্ভবপর ছিল। বর্তমান ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই মাসের
রপ্তানি আয় ব্যপকভাবে কমে যাওয়া এতদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যাগুলোর প্রতিফলনের শুরু
কিনা, তাও ভেবে দেখবার সময় এসেছে। রপ্তানি ঊন্নয়ন ব্যুরো এর তথ্যানুযায়ী তৈরি
পোশাক শিল্প খাত থেকে জুলাই, ২০১৬ এ আয় হয়েছে ২১১ কোটি ৭৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার। গেল
বছরের একই সময়ের চেয়ে এ আয় ১০ কোটি ডলার ও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৩.৬০% কম[1]।
স্বভাবতই, এরকম একটা বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকতে না পেরে বিগত ৩ বছরে তাই ৬৩৮
টির মতো তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান এবং রপ্তানি আয় ব্যাহত ও
হ্রাস পেয়েছে, দারীদ্র্য কমার হার হয়েছে শ্লোথ।
প্রসঙ্গত, গত বছরেই, শিল্প এবং ক্যাপ্টিভ পাওয়ার ইউনিটের জন্য গ্যাসের মূল্য
যথাক্রমে ১৫% এবং ১০০% বৃদ্ধি করা হয়[2]
যার সাথে খাপ খাইয়ে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তৈরি পোশাক শিল্পকে বেগ পেতে
হচ্ছে। এমতাবস্থায়, প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য নিম্নরূপে বৃদ্ধি করবার প্রস্তাব[3]
কোনভাবেই বাস্তবসম্মত নয় বরং এধরনের প্রস্তাব কার্যকরণ হলে শিল্পের উৎপাদন খরচ
বেড়ে গিয়ে তৈরি পোশাক শিল্পকে ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারের চেয়ে
প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে দেবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
টেবিল ১: প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রস্তাবিত মূল্য, বর্তমান মূল্য এবং মূল্যবৃদ্ধির হার।
উপরোক্ত প্রস্তাবিত প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির
সারণীতে দেখা যাচ্ছে যে ক্যাপ্টিভ পাওয়ার এবং শিল্প ইউনিটের জন্য যথাক্রমে ৬২% এবং ৭২% গ্যাসের
মূল্যবৃদ্ধি প্রস্তাব করা হয়েছে যা মোটেই শিল্পবান্ধব কোন প্রস্তাব হিসেবে প্রতিফলিত হয়নি। এই শিল্প
বিধ্বংসী প্রস্তাব গৃহীত হলে শতভাগ রপ্তানীমুখি ওভেন পোশাক শিল্প, নীট পোশাক শিল্প এবং এর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ একেবারেই
দূর্বল হয়ে ভেঙ্গে পড়বে তথাপি, তথাপি বাংলাদেশ সরকারের ২০২১ সালের
মাঝে এই খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় অর্জন করা একেবারেই দূরহ হয়ে
পড়বে।
তদুপরি, প্রস্তাবিত এই প্রাকৃতিক গ্যাসের
মূল্যবৃদ্ধি ব্যতিরেকে, বর্তমান বিশ্ব এবং দেশীয় প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প নিম্নোক্ত কয়েকটি কারণে ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে তার
প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হারাচ্ছে,
প্রথমত, সাম্প্রতিক অর্থবছর
২০১৬-১৭ এর জাতীয় বাজেটে রপ্তানি আয়ের উপরে উৎসে কর ০.৬% থেকে ১৬.৬৭% বৃদ্ধি করে
০.৭% শতাংশ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তৈরি পোশাক শিল্পে
ব্যবহৃত কিছু কাঁচামালের উপর আমদানি শুল্ক ৩% থেকে ৬০% বৃদ্ধি করে ৫% করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, বর্তমান পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক ক্রেতা
থেকে শুরু করে একর্ড, এলায়েন্স, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থান কর্পোরেশন (আইএফসি), বিভিন্ন দেশের ঊন্নয়ন সহযোগী, বাংলাদেশ সরকার এবং তৈরি পোশাক
শিল্পের উদ্যোক্তাদের গভীর মনোযোগ রয়েছে শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ এবং নিরাপত্তা
যথাযথভাবে উন্নয়ন করা। কিন্তু, ফায়ার এস্টিংগুইশার এবং
প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড্ বিল্ডিং মালামালের উপর আমদানি শুল্ক ৫% বহাল রাখা হয়েছে যা
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ০% এ নিয়ে আসার জন্য এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের আকূল আবেদন
ছিল।
চতুর্থত, তৈরি পোশাক শিল্পের
রপ্তানি আয় সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পেলেও, পোশাকের ইউনিট প্রতি দর গত
অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ সমূহে যথাক্রমে
২.৪৫% এবং ১.৪১% হ্রাস[4] পেয়েছে।
পঞ্চমত, বিগত অর্থবছরে মার্কিন
ডলার এর মান, বাংলাদেশি টাকার বিপরীতে ৭.৬৬% অবমূল্যায়িত হয়েছে যা তরি
পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয় অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।
ষষ্ঠত, ইতোমধ্যে আকাশপথে
বাংলাদেশ থেকে আগত মালামাল বহনকারী কার্গো বিমানের উপর যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি
নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যাতে করে বাংলাদেশে থেকে ঐসব দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের ‘পণ্য স্যাম্পল’ পাঠানো এবং
এর উপর ভিত্তি করে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি আদেশ অনেকাংশেই ব্যাহত হয়েছে।
সপ্তমত, দেশীয় উদ্যোক্তারা
সংশয়ে রয়েছেন, গ্রেট ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ অর্থ্যাৎ
ব্রেক্সিটের ফলে পাউন্ড স্টার্লিং এর মান বাংলাদেশি টাকার বিপরীতে প্রায় ১৭%
অবমূল্যায়িত হওয়ায় নিকট ভবিষ্যতে ব্রিটেন থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি আদেশ
অনেকাংশেই কমে যেতে পারে অথবা সেদেশের ক্রেতাগণ বাংলাদেশ থেকে আরও কম দামে পোশাক
ক্রয় করবার আদেশ প্রেরণ করতে পারেন।
অষ্টমত, বাংলাদেশের অন্যতম
প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতোমধ্যে তার টেক্সটাইল এবং তৈরি পোশাক শিল্পকে চাঙ্গা করবার
জন্য ও ২০১৮ সালের মাঝেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প হতে রপ্তানি আয়কে ছাড়িয়ে
বিশ্ব পরিমন্ডলে ২য় আসন গ্রহণ করবার লক্ষ্যে, ৩ বছর মেয়াদী কর্মসূচী গ্রহণ
করেছে। যার আওতায়, ২০১৬-১৮ পর্যন্ত, প্রতি বছর ৬০০০ কোটি টাকা ভারত তার
টেক্সটাইল এবং তৈরি পোশাক শিল্পে আর্থিক উৎসাহ হিসেবে প্রদান করবে। তদুপরি, এই কর্মসূচীর আওতায়
ভারত সরকার টেক্সটাইল এবং তৈরি পোশাক শিল্পে বিনিয়োগের উপর ২৫% করে আর্থিক ভর্তুকি
প্রদান করবে বলে কেবিনেটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এতে করে, অচিরেই ভারতের তৈরি
পোশাক শিল্পের সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্ব
বাজার থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
নবমত, বাংলাদেশের আরেকটি
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার এখন ব্যাপক 'সিরিজ কার্যক্রম' গ্রহণ করেছে ‘স্মার্ট
মিয়ানমার গার্মেন্টস’ কর্মসূচির আওতায়, তাদের তৈরি পোশাক
রপ্তানি বাবদ বৈদেশিক মূদ্রা আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে। ইতোমধ্যে, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং
বাংলাদেশ থেকেও সস্থা শ্রম-প্রাপ্তির দেশ মিয়ানমারের তৈরি পোশাক শিল্প হতে রপ্তানি
আয় ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সালের মাঝে ৯০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে প্রায় ১০০ শতাংশ
বৃদ্ধি পেয়ে ১.৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। অর্থ্যাৎ, বাংলাদেশ তার তৈরি
পোশাক শিল্পের সক্ষমতা মিয়ানমারের
সাপেক্ষে ক্রমশ হারাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য বিপদসংকেত বয়ে
নিয়ে আসছে।
উপরোল্লেখিত মহাপ্রতিকূল অবস্থায় প্রাকৃতিক গ্যাসের
মূল্য শিল্প এবং ক্যাপ্টিভ পাওয়ার ইউনিটের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি করবার প্রস্তাব অনেকটাই
দেশীয় এই শিল্পকে পঙ্গু করে দেয়ার শামিল। আর তাই, হলফ্ করেই বলে দেয়া যায়
যে প্রস্তাব গৃহীত এবং কার্যকরণ হলে, তৈরি পোশাক শিল্প এবং এর সাথে
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং খাত, দারীদ্র বিমোচন কার্যক্রম, ২০৪১ সালের মাঝে বাংলাদেশকে মধ্য
আয়ের দেশে পরিণত করা, ইত্যাদি উন্নয়নমূলক সকল ধরণের কার্যক্রম অচিরেই মুখ
থুবড়ে পড়বে এবং দেশ এক গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হবে।
দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এটি সহজেই অনুমেয় যে
দেশের গ্যাসের রিজার্ভ চাহিদার তুলনায় কমে আসছে। কিন্তু, এমতাবস্থায় প্রাকৃতিক
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি না করে, বৃহৎ আকারে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে
প্রতিবেশী প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ মিয়ানমারের কাছ থেকে সুলভ মূল্যে গ্যাস
আমদানি কার্যক্রম শুরু করা এবং প্রক্রিয়াধীন এলএনজি টার্মিনাল নির্মান দ্রুত
বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশীয় তৈরি পোশাক শিল্পে চাহিদা মোতাবেক প্রাকৃতিক গ্যাস
সরাবরাহ করলে এই খাত তথা বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম
হবে।
লেখকঃ ইনামুল হাফিজ লতিফী, জেষ্ঠ্য সহকারী সচিব, গবেষণা ও ঊন্নয়ন সেল্, বাংলাদেশ
নীটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)।
লেখাটি মূলত প্রকাশিত হয়েছেঃ
দৈনিক সমকাল, 'সম্পাদকীয় ও মন্তব্য'- পাতা, পৃষ্ঠা ৮, http://bangla.samakal.net/2016/08/18/231283 ১৮ আগস্ট, ২০১৬।
পরবর্তীতে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছেঃ
দৈনিক সিলেটের ডাক, 'উপ-সম্পাদকীয়' পাতায়, http://sylheterdak.com.bd/details.php?id=981 ২০ আগস্ট, ২০১৬।
রেফারেন্সঃ
No comments:
Post a Comment