একথা হয়তো না বললেও চলছে, বর্তমানে আমরা যে প্রধান সমস্যার সাথে প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছি, তা আর কিছু নয় বরং 'বিদ্যুৎহীনতা' বা সহজবোধ্য ভাষায় 'লোডশেডিং'। এই এক 'লোডশেডিং' এর জন্য আমাদের অর্থনীতি যেমন চাঙ্গা হতে পারছে না বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে ঠিক তেমনি জনজীবনে নেমে আসছে দুর্বিষহ যন্ত্রণা। ব্যাক্তিজীবনে যে 'লোডশেডিং' কত মাত্রার কোন বিপদ কিভাবে নিয়ে আসতে পারে তা ঐ ব্যক্তি মাত্রই বুঝে যে ঠিক এই মুহূর্তে ঐ পরিস্থিতিতে আছে। যাই হোক, সরাসরি চলে আসছি উল্লেখিত প্রসঙ্গে। এ লেখার মাধ্যমে এদেশে উদ্ভুত 'বিদ্যুৎ উৎপাদনজনিত' বিভিন্নমাত্রিক সমস্যা এবং তা থেকে পরিত্রাণে করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
একটা কথা এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই কয়েকদিন পূর্বে অনলাইনে 'আমাদের অর্থনীতি' পড়ার সময় দেখলাম, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য হয় বাংলাদেশ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস নিবে না হয় এদেশ থেকে বিদ্যুৎ নিবে। এবং বাংলাদেশের সরকারের সাথে আলোচনায় তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাহলে, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই, আসন্ন মহাসংকটকে আরও ঘনিয়ে আর ফেনিয়ে তুলছে আমাদের সরকার।
সূত্রঃ Climategate, Coal Mine Deaths, Air Pollution and Coals assault on human health
কয়লা উত্তোলনের যে উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার কথা সংসদীয় কমিটি প্রস্তাব করেছে তা উপরোল্লিখিত পরিবেশের দুই অবস্থার জন্যই মারাত্নক হুমকিস্বরূপ। কারণ এতে করে বাংলাদেশের ঐ অংশ যে মরূভূমিতে পরিণত হবে, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। আর দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ অত্যন্ত জনঘনবসতিপূর্ণ দেশ, এর ফলে সাধারণ মানুষের যে উচ্ছেদ হবে তারা কই গিয়ে আশ্রয় নিবে? না কি সরকার তাদের আবার আন্তর্জাতিক 'দাস প্রথা' কে আরও প্রসারিত করে শুধুই গৃহপরিচারিকাস্বরূপ সৌদি আরবে প্রেরণ করবে না কি তাদেরকে থাকার জায়গা নেই বলে বংগোপসাগরে ফেলে দিবে, সেটাও দেখার বিষয়।শেষ পর্যন্ত যা হবে তা হলো, পরিবেশও যাবে এবং খনিজ সম্পদ ও যাবে।
ইতোমধ্যে হয়তো সবাই যেনে থাকবেন যে আমাদের বর্তমান অত্যন্ত মেধাবী (!) সরকার এদেশীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যূৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানীগুলোর সাথে চুক্তি করে ফেলেছে এবং সে অনুযায়ী কাজও খুব তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যাবে ধারণা করছি। কিন্তু এই চুক্তিগুলোর কিছু সাধারণ আত্নঘাতী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা নিম্নরূপ।-
১) ঐ বিদেশী কোম্পানীগুলো উৎপাদিত বিদ্যুতের ৯০ শতাংশের মালিক হবে।
২) তারা সরকারের বেঁধে দেয়া প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়মূল্য না মেনে নিজেরা দাম নির্ধারণের ব্যাপারে স্বাধীন থাকবে।
৩) বাংলাদেশ কোন কারণে তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় করতে না চাইলে তারা পার্শ্ববর্তী দেশে এই বিদ্যুৎ বিক্রয় করতে পারবে।
অন্যদিকে আরও কিছু ব্যাপার জড়িত। এব্যাপারগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাহলো, কয়লা থেকে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব? অনেককেই বলতে দেখছি, এই এক আভ্যন্তরীণ কয়লাক্ষেত্র দিয়েই বাংলাদেশের সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব এবং তা প্রায় ২০- ২৫ বছর।
অন্যদিকে আরও কিছু ব্যাপার জড়িত। এব্যাপারগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাহলো, কয়লা থেকে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব? অনেককেই বলতে দেখছি, এই এক আভ্যন্তরীণ কয়লাক্ষেত্র দিয়েই বাংলাদেশের সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব এবং তা প্রায় ২০- ২৫ বছর।
এখন কথা হচ্ছে সত্যিই যদি এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তবে এই মূহুর্তে বাংলাদেশে Excess Electricity থাকবে। যার দরূণ, স্বাভাবিকভাবেই এদেশের বিপদের সময় কাজে আসতে পারে এমন বিদ্যুৎ শুধুমাত্র সময়ের সাথে অপ্রাসংগিক এবং অপরিপক্ক কাগজিক চুক্তির কারণে অন্যদেশে চলে যাবে।
![]() |
ছবিঃ উত্তোলিত কয়লা স্থানান্তরে ব্যাস্ত চার শ্রমিক |
উপরের লেখায় যা প্রকাশ পাচ্ছে, তা হলো প্রথমত আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি হলো সরকারি ব্যাপার। দুই ক্ষেত্রের মানুষের আচার- আচরণ আর চিন্তা- ভাবনার দক্ষতা ভিন্ন পর্যায়ের। প্রথমদিকটায় যেমন মেধাবী অথচ লোভী আমলাদের জটলা, দ্বিতীয় দিকটায় তেমনি চরম লোভী ব্যাবসায়ীদের বাড়ন্ত ভিড় লক্ষণীয়। দুই জগতের মানুষ হলেও এক জায়গায় এদের চরম মিল। আর তা হচ্ছে, নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে, দেশবাসীকে মহাবিপদে ঠেলতেও একটুও দ্বিধা না করা।
যাই হোক, এক্ষেত্রে তাদের কি ইচ্ছা এটা তারাই বলতে পারবেন!
এখন আসি, কয়লা উত্তোলন এর ফলে পরিবেশের কি ক্ষতি হবে তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায়। এর আগে আরেকটা জিনিষ নিয়ে বলতে চাই, আর তা হলো- 'Environmental Sustainability'.
এই ব্যাপারটা আবার দুই রকমের হতে পারে-
১) For Short Run
২) For Long Run.
![]() | |
ছবিদ্বয়ঃ ২২/১১/২০০৯ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে কয়লা উত্তোলনের ফলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া। |
কয়লা উত্তোলনের যে উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার কথা সংসদীয় কমিটি প্রস্তাব করেছে তা উপরোল্লিখিত পরিবেশের দুই অবস্থার জন্যই মারাত্নক হুমকিস্বরূপ। কারণ এতে করে বাংলাদেশের ঐ অংশ যে মরূভূমিতে পরিণত হবে, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। আর দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ অত্যন্ত জনঘনবসতিপূর্ণ দেশ, এর ফলে সাধারণ মানুষের যে উচ্ছেদ হবে তারা কই গিয়ে আশ্রয় নিবে? না কি সরকার তাদের আবার আন্তর্জাতিক 'দাস প্রথা' কে আরও প্রসারিত করে শুধুই গৃহপরিচারিকাস্বরূপ সৌদি আরবে প্রেরণ করবে না কি তাদেরকে থাকার জায়গা নেই বলে বংগোপসাগরে ফেলে দিবে, সেটাও দেখার বিষয়।শেষ পর্যন্ত যা হবে তা হলো, পরিবেশও যাবে এবং খনিজ সম্পদ ও যাবে।
এতটুকু পড়ার পর অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশের সীমায়িত গ্যাস সম্পদ শেষ হওয়ার পর কি হবে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই দেশ? নিজের দেশের কয়লাও যদি না ব্যাবহার করতে উৎসাহী করা হয়, তবে কি একসময় এদেশ বিদ্যূতের অভাবে প্রস্তর যুগে ফিরে যাবে?
আসলে এর সমাধান কয়েকটা পথের একত্রীকরণের মাধ্যমে করতে হবে। যেগুলো করা উচিত বলে আমি মনে করি, তা নিম্নরূপ-
১) সোলার প্যানেল এর আওতায় বাংলাদেশের প্রতিটা ঘর, প্রতিটা এপার্টমেন্টকে পর্যায়ক্রমে আনতে হবে। এখনও এই উদ্যোগ আছে, কিন্তু তা খুব জোরালো নয়। এটাকে আরও জোরালো করতে হবে।
২) কয়লানীতিতে নিজের কয়লা ব্যাবহার এই সময়ের প্রেক্ষিতে বাদ দিয়ে কয়লা আমদানী শুরু করতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি ততটা সমর্থ নয়, খুব বেশি পরিমাণ কয়লা ক্রয় করার, তাই শুরু করতে হবে অল্প অল্প করে। এমনভাবে পরিকল্পনা সাজাতে হবে যেন ১০- ১৫ বছরের মাঝে গ্যাসের মাধ্যমে যে বিদ্যৎ উৎপাদন হয় ঠিক সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে তখন কয়লা ক্রয় করেই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারে।
৩) নতুন ধরনের করের সাথে এদেশের নাগরিকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া উচিত। আর তার নাম দেয়া যায় 'কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কর'। মাসে ১০০ টাকা করে কর্মক্ষম আনুমানিক ৯ কোটি মানুষের কাছ থেকে আদায় করলে (৯০০ কোটি প্রতি মাস * ১২ মাস)= ১০৮০০ কোটি প্রতি বছর আদায় করা হবে। আর এই অর্থ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা তো ভালভাবে ক্রয় করা যাবেই, তার উপর একটা অংশ দিয়ে Bangladesh University of Professionals এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন নতুন সাশ্রয়ী ও আরও বেশি পরিবেশবান্ধব কৌশল উদ্ভাবনের জন্য গবেষণাকে উৎসাহ দিয়ে এক্ষেত্রে গবেষণা করতে ইচ্ছুকদের মাসিক ভাতা দেয়া যাবে।
৪) কোন দেশের সাথে বিদ্যুৎ বিক্রয়ের চুক্তিতে না গিয়ে বরং বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিতে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
৫)ধীরে ধীরে বাপেক্সকে নতুন নতুন প্রযুক্তি দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। বাপেক্সকে যদি কয়লা উত্তোলনে দক্ষ করা সম্ভব না হয়, তবে এর জন্য বিশেষায়িত আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত ও মেধাবীদের দ্বারা নতুন কোম্পানী গঠন করা।
৬) প্রত্যেকটি নতুন আসন্ন বড় বড় দেশি এবং বেদেশি কোম্পানীর সাথে এই চুক্তি করতে হবে যে, তারা এদেশের গ্যাস ব্যাবহারের মাধ্যমে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তা না নিয়ে বরং নিজেদের বিদ্যুৎ নিজেদের তৈরি করার জন্য ডিজেলভিত্তিক প্লান্ট বসাতে হবে এবং প্লান্টগুলো পরিচালনার জন্য তারা ডিজেল সরকারের কাছ থেকে ক্রয় করতে বাধ্য থাকবে, যেখানে সরকার ডিজেলে তাদের জন্য কোন ভর্তুকি দিবে না।
সর্বোপরি নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে প্রশাসক সবাইকে দেশ পরিচালনা, সিদ্ধান্ত নেয়া, তা বাস্তবায়ন করা এবং যেকোন চুক্তি স্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে অবশ্যই সৎ হতে হবে। কারণ, এদেশের বড় বড় ক্ষতিগুলো হয় অসততার জন্যই।
No comments:
Post a Comment