Tuesday, March 15, 2016

তুমি এবং তোমার সংকল্পঃ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দাও পৃথিবীকে

“আমরা সিঁড়ি, তোমরা আমাদের মাড়িয়ে- প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও, তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে; -তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক, পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন |”                                           ~ সুকান্ত ভট্টাচার্য, ১৫ আগস্ট ১৯২৬ থেকে ১৩ মে ১৯৪৭

প্রতিনিয়ত অনলাইনে কিছু না কিছু পড়া হয়, আজ বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়তে গিয়ে সামনে চলে আসলো উপরের এই কবিতাংশটুকু। যদিও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘সিঁড়ি’- কবিতাটি লিখবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন, কিন্তু আমার মনের ভিতরে যে বিষয়টি কাজ করছিল তার সাথে একেবারে মিলে যাচ্ছে, এবং বলা যায় যে আমি এখন যে কথাগুলো হাজারটা শব্দ ব্যবহার করে লিখতে যাচ্ছি, তা কবি মশায় মাত্র কয়টা লাইনের মাঝেই পুরোটা বলে দিয়েছেন। যাই হোক, এই লেখাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যকিছু আলোচনা করা, এবং এটি একটি ভবিষ্যতে চলমান সিরিজের একটি সূচনামূলক লেখা হয়ে থাকতে পারে!

আমরা নিশ্চয়ই প্রায় সবাই-ই ‘মাইক্রোসফট্‌’ এর নামের সাথে পরিচিত, এর থেকেও হয়তো বেশি পরিচিত এর একাধিনায়ক ‘বিল গেট্‌স্‌’ নামটির সাথে, সময়ের সবচাইতে ধনী মানুষের নাম বরাবরই কারণে-অকারণে সবার মুখে চলে আসে (হয়তো শৈশবে গণিতের নামতা শিখবার আগেই এখন অনেকে তার নাম জেনে ফেলে!)। তো বিল গেট্‌সের প্রতিষ্ঠিত মাইক্রোসফটে ২০১৫ সালের জুনের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী কর্মরত আছেন ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ[1]। ক্ল্যাসিকাল ইকনোমিস্ট এডাম স্মিথ ১৭৭৬ সালে লিখিত তার বিখ্যাত দ্য ওয়েলথ্‌ অব নেশনে  উল্লেখ করেছিলেন, “যখনই কোথাও ব্যপক বিত্ত-বৈভব আছে, ঠিক সেখানেই রয়েছে চরম বৈষম্য। একজন ধনী লোকের জন্য সেখানে অবশ্যই পাঁচশত দরীদ্র মানুষ থেকে থাকবে”[2]। 


এডাম স্মিথের সঙ্গা অনুযায়ীও বিল গেটস্‌ শুধুমাত্র ধনী নন, তিনি হলেন মহা-মহা এবং মহাধনী। মাইক্রোসফটের বর্তমান সম্পদমূল্য হচ্ছে ৩৪০.৮ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার[3] (‘মার্কিন’ নামের শব্দটি ব্যবহার করবার কোন উপযুক্ত কারণ আন্তর্জাতিকভাবে নেই বলেই মনে করি), বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ২০১৫ সালে ২০৯ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার[4], অর্থ্যাৎ মোটাদাগে বুঝে ফেলা যায় বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের চেয়েও মাইক্রোসফটের ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৪ জনের লোকবল অনেক বেশি উৎপাদনশীল এবং সৃজনশীল। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত একজন ব্যাক্তির বাৎসরিক আয় গড়ে ১ লাখ যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলারের মতো[5], সেই হিসাবে ২০১৫ সালে তাদের আনুমানিক সামগ্রিক বেতন ছিল ১১.৮ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার। একই সময়ে তাদের নেট রেভেনিউ ছিল ৯৩.৫৮ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার, অর্থ্যাৎ বর্তমান প্রচলিত অর্থনীতি বাকি প্রায় ৮১ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার উপরের দিকে নিয়ে গেছে, ক্ষমতা যুগিয়েছে দেশীয় অর্থনীতিতে, নেট ইনকাম বা নেট লাভ হিসেবে মাইক্রোসফট্‌ শেয়ার হোল্ডারদের দিয়েছে ১২.১৯ বিলিয়ন ডলার[6]।


পাঠক, তুমি কি বুঝতে পারছো যে আসলে কি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সেখানে? মাইক্রোসফটে কর্মরত ১ লাখ ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষের বাৎসরিক বেতন ১১.৮ বিলিয়ন ডলার আর এদের শ্রম-মেধাই এনে দিয়েছে ১২.১৯ বিলিয়ন ডলারের মুনাফা যার উপর এদের কোন মালিকানা নেই, মালিকানা আছে বিল গেটসের মতো শেয়ার হোল্ডারদের। অর্থ্যাৎ, মাইক্রোসফটের কর্মী-বাহীনি তাদের বাজারজাতকৃত শ্রম-মেধামূল্যের অর্ধেকের চেয়েও কিছু কম অর্থ পাচ্ছেন। বিল গেটসের মতো মহা-মহা এবং মহাধনী এভাবেই ‘বাস্তব অর্থনীতি’ এর বিভিন্ন কলা-কৌশলের মাধ্যমে এরকম লাখো-লাখো মানুষের উৎপাদিত মূল্য সুপেয় ফলের জুস্-এর মতো পান করে যাচ্ছেন, এবং সত্যি বলতে কি এতে বিল গেটসের সত্যিই কোন দোষ নেই। 

প্রতিটা মানুষই জন্মায় অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে, সাধারণ মানুষতো বটেই এমনকি মাইক্রোসফটে কর্মরত ওয়ার্ল্ডক্লাস প্রমাণিত ট্যালেন্টও বুঝে উঠতে পারে না যে আসলে তার দ্বারাই অনেক কিছু সম্ভব, যদি বুঝতে পারতো- তাহলে কম করে হলেও এদের কর্মকর্তারাই ১০০০ টা মাইক্রোসফটের মতো কোর্পোরেশন খুলে বসতো। আত্নবিশ্বাস এমন একটা ব্যাপার, যা মানুষকে নিজের মাঝে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখায়। 

আসা যাক আমাদের দেশের একটা ঊদাহরণে, গ্রামীণ ব্যাংকের কথা সবাই হয়তো কম বেশি জেনে থাকবে, যেখানে ৯৭ শতাংশ ঋণকারীই হচ্ছে মহিলা এবং বিশেষায়িত প্রধানত কাজ করছে গ্রামে, শহরে নয়, শিল্পের সাথে নয় বরং একদম প্রান্তিক মানুষের সাথে। অথচ শুরু করবার সময় নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনুস নিজেই জানতেন না যে এটা এতো বিশাল হয়ে বাংলাদেশ তথা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু, তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আর তাই এই উদ্যোগ ছিল সমাজের একটা নির্দিষ্ট সমস্যা কোনভাবে সমাধান করা।

আরও একটা দেশীয় ঊদাহরণে আসা যাক, এদেশে ইসলামী ব্যাংকিং শুরু হয় ১৯৮৩ সালে[7], তখন তাদের উদ্দেশ্য ছিল সুদমুক্ত মুনাফাভিত্তিক ব্যাংকিং চালু করে সত্যিকার অর্থে মানুষকে আর্থিক সেবা দেয়া (যদিও এখনো পর্যন্ত শতভাগ ইসলামী পন্থায় যাওয়া বৈশ্বিকভাবে সম্ভব হয়নি, কিন্তু বর্তমানে অনেকগুলো জিনিসই খুব ভালভাবে পালন করা হচ্ছে, এবং হয়তো নিকট ভবিষ্যতেই আমরা বিশ্বব্যাপী পুরোপুরি মাত্রায় ইসলামিক ব্যাংকিং পাবো)। শুরু করবার সময়, এমনটা স্বপ্নেও ভাবা দুষ্কর ছিল যে, ইসলামিক ব্যাংকগুলোর মাঝে কোনটি এক সময় সর্বোচ্চ লাভ অর্জন করতে সক্ষম হবে কখনো (প্রসঙ্গত, ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ এর অর্জিত লাভ ছিল ১৮০৭ কোটি টাকা বা ২৩ কোটি ডলার প্রায়, যা গত অর্থবছরে বাংলাদেশে পরিচালিত সব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাঝে সর্বোচ্চ)।

আমরা হয়তো শুধু উদ্যোগের সফলতার কথাই বললাম-পড়লাম, ব্যর্থতার কোন ঊদাহরণই হয়তো টানলাম না, পাঠক হয়তো ধরে নিবে এতোটুকু পড়ে যে, উদ্যোক্তা তৈরি করাই এই লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য, বিষয়টা আসলে একেবারে সেটা নয়। ইকোনমিক্সে এবং বাস্তবেও দেখা যায়, কোন মানুষ ঝুঁকি প্রিয় হয় আবার অন্য কেউ ঝুঁকি বিমুখও হয়, আবার এখানে একটা মধ্যম দলও থাকে যারা এক্সট্রিম ঝুঁকি আর একদম ঝুঁকিহীনতার মাঝে একটা গড় করে মধ্যম-পন্থা অনুসরণ করে। বাস্তবক্ষেত্রে এর একটা প্রয়োগ এমন হতে পারে যে, একজন মানুষ চাকুরি করলো আবার ব্যবসাও করলো- শুনে প্রথমে মনে হতে পারে এটা একটা কাল্পনিক কথা, কারণ চাকুরি করেই তো সময় পাওয়া যায় না। তবে আমি আমার আশেপাশে ভাল করে অবলোকন করে দেখলাম, যারা চাকুরীজীবি এবং সেই সময়ে ব্যবসা শুরু করেন, তারাই বেশি সফল- এর একটা কারণ হতে পারে যে, একজন চাকুরীজীবি প্রতিষ্ঠিত একটা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে বুঝতে পারে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান- শিল্প সম্পর্কে কেমন হওয়া উচিত এবং লাভের জায়গাটা আসলে কিভাবে নিরাপদ করা যায়, সোজা ভাষায়- ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি সে আরও ভালভাবে নিতে শিখে।

পৃথিবীতে এখন গড়ে প্রতি ১২ বছরে ১ বিলিয়ন (=১০০ কোটি) করে মানুষ বাড়ছে, সে হারে চাকুরি বাড়বে, সে আশা করাটা এখন আসলেই বোকামি। আমাদের নিজেদের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে হবে, নিজেদের কর্মসংস্থান নিজেকেই করতে হবে, কয়েকটা বছর পর এমন একটা সময় আসবে যখন কোন সরকার চাইলেও ব্যাপক কর্মসংস্থান করতে পারবে না- চাহিদা অনুযায়ী। তবে একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না, মানুষই সবকিছুর নিয়ামক, মানুষই ক্রেতা এবং সেই-ই বিক্রেতা, সেই ব্যাবহারকারী এবং সেই-ই উৎপাদনকারী, মানুষই হলো ‘বাজার’ এবং ‘অর্থ- টাকা/ডলার’ গঠনের প্রধান শর্ত, মাঝে ‘সরকার’ বা অন্য যে কোনকিছুই কেবল অদৃশ্য তৃতীয়পক্ষ। তাই, ঐতিহাসিকভাবে এখনো, নতুন কিছুর উদ্যোগ ব্যক্তিপর্যায়ে আমাদেরই নিতে হবে। আর উদ্যোগ নেয়ার প্রথম উপাদানই হচ্ছে তোমার প্রচন্ডরকমের ইচ্ছা, এই দৃঢ় ইচ্ছা বা সংকল্পই তোমার মাঝে চূড়ান্ত ক্ষুধা তৈরি করবে, রসদ জোগাবে এমনকিছু পরিকল্পনা নিয়ে আজ মাঠে নামবার যা হয়তো তুমি গতরাতেও চিন্তা করোনি। পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ দেয়ার এই সুযোগটা কি হাতছাড়া করতে চাও তবে?

শেষ করবো পবিত্র কুর্‌’আন এর সূরা আল-হাজ্ব এর একটি আয়াত দিয়ে, 

“...নিশ্চয়ই, আল্লাহ্‌ তাদেরই সাহায্য করেন যারা নিজেরা নিজেদের সাহায্য করে (কাজে/কোন কারণে/সমস্যায়)। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌, মহা-শক্তিশালী, পরাক্রমশালী।“ (সূত্রঃ আয়াত নং ৪০, চ্যাপ্টার নং ২২, সূরা আল-হাজ্ব, পবিত্র কুর’আন)

লেখকঃ ইনামুল হাফিজ লতিফী, সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, বাংলাদেশ নীটওয়্যার ম্যানুফেকচারিং এন্ড এক্সপোর্টিং এসোসিয়েশন; ভাইস্‌ প্রেসিডেন্ট, সিলেট চ্যাপ্টার, বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ।

 রেফারেন্স
[1] http://news.microsoft.com/facts-about-microsoft/
[2] https://goo.gl/nWIifG 
[3] http://www.forbes.com/companies/microsoft/ 
[4] https://www.gfmag.com/global-data/country-data/bangladesh-gdp-country-report 
[5] https://www.glassdoor.com/Salary/Microsoft-Salaries-E1651.htm
[6] http://news.microsoft.com/facts-about-microsoft/ 
[7] http://print.thefinancialexpress-bd.com/2015/03/31/86909 

এই লেখাটি এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছে নিম্নোক্ত নিউজ সাইটগুলোয়,

১) http://bangla.moralnews24.com/?p=45740
২) http://parisvisionnews.com/2011-10-19-15-40-00/111-political/12546-2016-03-22-13-47-20.html

No comments:

Post a Comment